জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী – Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali
স্যার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) ছিলেন একজন মহান ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানী । বেশিরভাগ মানুষ তাকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হিসেবে জানলেও, তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ছাড়াও একজন মহান পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী, বহুশাস্ত্র এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) সর্বপ্রথম প্রমাণ করেছিলেন যে উদ্ভিদেরও প্রাণ রয়েছে এবং তারাও উত্তেজনায় সাড়া দেয়। এর সাথে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি বেতার (Radio) এবং মাইক্রোওয়েভ অপটিক্স আবিষ্কার করেছিলেন।
জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) প্রমান করেছিলেন যে, বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা করা যায় ও তাতে সাফল্য পাওয়া যায়। বহুমুখিতা সমৃদ্ধ জগদীশ চন্দ্র বসু সেই সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর দুর্দান্ত আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন – আইনস্টাইনের চেয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা কম নয়। তাঁর আবিষ্কৃত রেডিও বা বেতার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদান । সেইজন্য তিনি রেডিও বিজ্ঞানের জনক হিসেবেও পরিচিত।
জগদীশ চন্দ্র বসু সাধারণ মানুষের মাঝে পরিচিত ‘গাছের প্রাণ আছে’ এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। এছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর নিঃশঙ্ক পদচারণা আমাদের অবাক করে দেয়। একাধারে জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন পদার্থবিদ এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। জগদীশ চন্দ্র বসু কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন বিজ্ঞানের সব বিষয়গুলি একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।
বাঙালি পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর(Jagadish Chandra Bose) একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী ।

জগদীশ চন্দ্র বসু কে ছিলেন ?
জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) ছিলেন একজন বাঙালি পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক এবং গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় জগদীশ চন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) হাত ধরে হয় বলে মনে করা হয়। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স জগদীশ চন্দ্র বসুকে (Jagadish Chandra Bose) রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক হিসেবে অভিহিত করে। তাঁকে আমরা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু হিসাবেই চিনে থাকি ।
জগদীশ চন্দ্র বোস আমেরিকান পেটেন্ট প্রাপ্ত ভারতের প্রথম বিজ্ঞানী ছিলেন । আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে উল্লেখ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ”।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনীছক
নাম (Name) | জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) |
জন্ম (Birthday) | ৩০শে নভেম্বর, ১৮৫৮ (30th November 1858) |
জন্মস্থান (Birthplace) | বিক্রমপুর, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ) |
অভিভাবক (Parents)/পিতামাতা | পিতাঃ ভগবান চন্দ্র বসু মাতাঃ বামাসুন্দরী দেবী |
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় |
দাম্পত্য সঙ্গী (Spouse) | অবলা বসু |
কর্মক্ষেত্র | পদার্থবিজ্ঞান, জৈবপদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কল্পবিজ্ঞান |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় |
শিক্ষায়তনিক উপদেষ্টা | জন উইলিয়াম স্ট্রাট |
পরিচিতির কারণ | মিলিমিটার তরঙ্গ, বেতার, ক্রেসকোগ্রাফ, উদ্ভিদবিজ্ঞান |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | সিআইই (১৯০৩), সিএসএই (১৯১১), নাইট ব্যাচেলর (১৯১৭) |
মৃত্যু (Death) | ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ (13th November 1937) |
উল্লেখযোগ্য ছাত্র | সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শিশির কুমার মিত্র |
জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম
জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) ১৮৫৮ সালের ৩০ শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের বিক্রমপুর জেলার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ) রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
‘গাছেরও প্রাণ আছে’ উদ্ভিদবিজ্ঞানে এইতত্ব আবিষ্কারের জনক তিনি।

জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতামাতা
জগদীশ চন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন । কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বর্ধমান, ফরিদপুর ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সহকারী কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তাঁর মাতা ছিলেন বামাসুন্দরী দেবী । তিনি একজন গৃহিণী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর কলকাতার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূত্রে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর শৈশব জীবন
জগদীশচন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) বাল্যকাল কেটেছে অধুনা বাংলা দেশের ফরিদপুর গ্রামে । স্বাভাবিক ভাবে সেই কারণে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সেই গ্রামের বিদ্যালয় থেকে শুরু করেন । গ্রামের পরিবেশে থেকেও এতো বড় মহান মানুষ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা সকলের নজর কেড়ে নিয়েছে ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর শিক্ষা জীবন
জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রাথমিক শিক্ষা
জগদীশচন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) বাবা ভগবান চন্দ্র তাঁর ছেলেকে সহজেই স্থানীয় ইংলিশ স্কুলে পাঠাতে পারতেন কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে ইংরেজি ভাষা শেখার আগে তাঁর মাতৃভাষা শিখুক এবং তার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুক। তিনি মনে করতেন জগদীশ যদি নিজের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয় তাহলে বাল্য জগদীশের মনে স্বদেশ প্রেমের ভাবনা জাগ্রত হবে।
তাঁর পিতার ইচ্ছামতন কয়েক বছর সে তাঁর গ্রামে নিজের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার পরে, জগদীশ চন্দ্র বোস ১৮৬৯ সালে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল।
জগদীশ চন্দ্র বসুর উচ্চশিক্ষা
গ্রামের পড়া শেষ হলে এক সময় জগদীশ চন্দ্রকে (Jagadish Chandra Bose) কলকাতার বিখ্যাত স্কুল সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় । সেখান থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস (বর্তমানের ম্যাট্রিক) পাস করেন ।
ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । ঐ কলেজ থেকে তিনি ১৮৮০ সালে বিএ পাস করেন । জগদীশ চন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) ইচ্ছা ছিলো বিলেতে গিয়ে কিছু শিখে আসা । তাঁর বাবাও চাইতেন ছেলে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু শিক্ষা গ্রহণ করুক । শেষ পর্যন্ত বিএ পাস করে জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) ডাক্তারী পড়তে লন্ডনে পাড়ি জমালেন । যথানিয়মে তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় পাসও করলেন । কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য ডাক্তারী পড়া সম্ভব হলো না । ১৮৮২ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন ত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন এবং তাঁর ভগ্নিপতি আনন্দমোহন বসুর কথামতন জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজে আসেন। সেখানে তিনি ক্রিস্ট কলেজে ভর্তি হন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করেন।
শেষ পর্যন্ত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উদ্ভিদতত্ব রসায়ন শাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যায় ট্রাইপস ডিগ্রী লাভের জন্য চললো জগদীশচন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) সংগ্রাম । সে পরীক্ষায় তিনি সাফল্যের সাথে কৃতকার্য হলেন । সেই সঙ্গে ১৮৮৪ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন ।
কিন্তু অসুস্থ স্বাস্থ্যের কারণে তিনি ১৮৮৪ সালে পড়াশোনা সম্পন্ন করে দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) ১৮৯৬ সালে আবার ইংল্যান্ডের লন্ডনে যান এবং সেখানকার বিখ্যাত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
জগদীশ চন্দ্র বসুর কর্মজীবন
১৮৮৪ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদান করেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় ।
যদিও তাঁকে (Jagadish Chandra Bose) নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তবে তাঁকে ওই পদে নির্ধারিত বেতনের অর্ধেক বেতন দেওয়া হতো । জগদীশ চন্দ্র বসু এই বৈষম্যের অনেক বিরোধিতা করেছিলেন এবং সেই পদে কর্মরত একজন ইউরোপীয়কে যে বেতন দেওয়া হচ্ছে তিনি তার সমান ও ন্যায্য বেতন দাবি করেছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর প্রতিবাদের বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষের দিক থেকে বিবেচনা করা হয়নি। সেই কারণে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বেতন নিতে অস্বীকার করেছিলেন এবং তিন বছর বিনা বেতনে তাঁর শিক্ষকতার কাজ চালিয়ে যান ।

তিনি কলেজে পাঠ্যবিষয়কে বাস্তব পরীক্ষার সাহায্যে এমন ভাবে প্রাণবন্ত করতে পারতেন যে, ছাত্ররা সব চমৎকৃত ও মুগ্ধ হয়ে পড়তো । শুধু পড়ানোর দক্ষতায় নয়, তাঁর ন্যায় নিষ্ঠা ও দৃঢ়তা শত্রুকেও বশ মানিয়ে তাঁর প্রতি অনুকুল করে তুলতো ।
শেষ পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ জগদীশ চন্দ্র বসুর (Jagadish Chandra Bose) যোগ্যতা এবং চরিত্রকে পুরোপুরি উপলব্ধি করেন এবং নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর নিয়োগকে পুরোপুরি স্থায়ী করে দেন। বিগত তিন বছর ধরে তাঁর প্রাপ্ত মোট বেতনও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তারপর থেকে তহবিল এবং বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামের অভাব সত্ত্বেও জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
৩৫ বছর বয়সে তাঁর জন্মদিনের এক উৎসবে তিনি নিজেকে পুরোপুরি বিজ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত রাখার শপথ নিলেন । শিক্ষক হিসাবে বোস তাঁর ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। জগদীশ চন্দ্রের জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে গিয়েছিল এইসময় । পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি হারিয়েছেন তাঁর পিতা –মাতা দুই জনকে ।
প্রেসিডেন্সি কলেজের তাঁর অনেক শিক্ষার্থী প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন সত্যেন্দ্র নাথ বোস, মেঘনাদ সাহা ও শিশির কুমার মিত্র।
১৮৯৫ সালে জগদীশ চন্দ্র বসুর বিদ্যুৎ বিষয়ক মৌলিক গবেষণার বিষয় লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয় ।
বিজ্ঞান চর্চায় জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান
বাংলায় বিজ্ঞান চর্চায় জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান সত্যিই অনস্বীকার্য । তিনি ১৮৯৪ সাল থেকে শিক্ষকতার সাথে সাথে নিজেকে গবেষণা এবং পরীক্ষাগুলিতে সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি ছোট ঘরকে একটি পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করেছিলেন। এখানে তিনি অপসারণ, বিচ্ছিন্নতা এবং মেরুকরণ সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন।
তিনি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ডিভাইস তৈরি করে যা রেডিও তরঙ্গকে জ্ঞান দেয় তৈরি করেছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে অবিচ্ছিন্ন ব্যবহারের সাথে সেই ডিভাইসটির সংবেদনশীলতা হ্রাস পেয়েছে এবং তার সংবেদনশীলতা ব্যবহারের স্বল্প বিরতির পরে ফিরে এসেছিল। এখান থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে ধাতবগুলিরও আবেগ এবং স্মৃতি থাকে।
বোস সর্বপ্রথম এমন একটি যন্ত্র ডিজাইন করেছিলেন জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা।
জগদীশ চন্দ্র বসুর ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আবিষ্কার
জগদীশ চন্দ্র বসুকে ‘ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি’র আবিষ্কারক বলা ভুল হবে না, কারণ মার্কোনি আবিষ্কারের পেটেন্ট আবিষ্কারের মাত্র এক বছর আগে জগদীশ চন্দ্র বসু সবার সামনে তাঁর আবিষ্কার ও গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন।
বিনা তারে কিভাবে খবর পাঠনো যেতে পারে তা তিনি কলকাতায় এক বক্তৃতায় প্রকাশ করেন এবং ছোট যন্ত্রের সাহায্যে নিজের বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে কলেজের সঙ্গে বিনা তারে সঙ্কেত আদান –প্রদানও করেছিলেন । তবে তাঁর এই আবিষ্কার বিদেশে প্রচারিত হবার আগেই ইটালীর সমসাময়িক কালের অপেক্ষাকৃত তরুণ বিজ্ঞানী মার্কোনি বেতার টেলিগ্রাফ পদ্ধতির জনক বলে স্বীকৃতি পান দেশে ও বিদেশে ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের আবিষ্কার
১৮৯৫ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সন্ধান এবং কোনও তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্ৎস প্রত্যক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এনিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন, যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান।
জগদীশ চন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরনের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
জগদীশ চন্দ্র বসুর বিখ্যাত আবিষ্কার “গাছেরও প্রাণ আছে”
ভারতের অন্যতম মহান বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন। আজ তাঁর কারণে আমরা গাছগুলি এবং তাদের কার্যক্রমগুলি খুব ভালভাবে জানতে পেরেছি।
১৯০০ সালের ১০ মে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির কেন্দ্রীয় হলে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জমাটি ভরা সভায় জগদীশ চন্দ্র বসু একটি পরীক্ষা প্রদর্শন করে দেখান যে, উদ্ভিদের অন্যান্য জীবজন্তু এবং মানুষের মতো প্রাণ ও অনুভূতি রয়েছে।
উদ্ভিতের যে প্রাণ আছে তা প্রমান করার জন্য জগদীশ চন্দ্র বসু একটি উদ্ভিদ বেছে নিয়েছিলেন, সঙ্গে নিয়েছিলেন ব্রোমাইড দ্রবণ । একটি জারে ব্রোমাইড দ্রবণের মধ্যে উদ্ভিদটির কান্ড পর্যন্ত সাবধানে ডুবিয়ে রাখেন। তিনি উদ্ভিদের সাথে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যুক্ত করেন, যা একটি পর্দায় আলোকিত স্পট তৈরি করবে । সেই স্পটটি বীট হিসাবে উদ্ভিদের গতিশীলতা দেখাবে ।
এইবার ব্রোমাইড দ্রবণে সেই উদ্ভিদটি ডুবিয়ে রাখা হয় । কিছুক্ষণের মধ্যে যখন সেই গাছটি ব্রোমাইড দ্রবণ শোষণ করে, তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই পর্দায় প্রদর্শিত স্পটটি পেন্ডুলামের মতোই চলাচল শুরু করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্পটটি দ্রুত স্পন্দিত হয় এবং অবশেষে হঠাৎ স্টপ হয়ে যায় ।
অনুষ্ঠানটি অনেক প্রশংসা ও করতালি দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল । তবে কিছু পদার্থ বিজ্ঞানী সন্তুষ্ট ছিলেন না । কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসু “উদ্ভিতের প্রাণ আছে” বিষয়টির উপর খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন । পরবর্তীকালে তিনি ভালোমতন ব্যাপারটি প্রমান করা জন্য কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
জগদীশ চন্দ্র বসুর ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু গাছের বৃদ্ধি পরিমাপের জন্য ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রটিও আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি এই ডিভাইসের সাহায্যে গাছের অগ্রভাগের বৃদ্ধি পরিমাপ করে দেখান । এছাড়া একটি গাছ বাইরের উদ্দিপক যেমন– তাপমাত্রা, রাসায়নিক পদার্থ, গ্যাস ও তড়িৎ প্রবাহ ইত্যাদির উপস্থিতিতে কিরূপ আচরণ করে সেই পরীক্ষার ব্যাখ্যা ও প্রদর্শন করেন।
তিনি গাছেরও প্রাণ আছে এই তত্ব প্রমাণ করেন । এই তত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি নানা ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন পরীক্ষা –নিরীক্ষার প্রয়োজনে ।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সম্মান ও পুরস্কার
বিজ্ঞানে অতুলনীয় অবদানের কারণে তাঁকে যোগ্য পুরষ্কার ও সন্মান দিয়ে ভূষিত করা হয় । স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্দেশ্যে মহান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন– “জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।”
- রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনকঃ ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক হিসেবে অভিহিত করে।
- ডক্টরেট উপাধিঃ ১৮৯৬ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিএসসি’ বা ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন ।
- কম্পায়েন্ট অফ দ্য অর্ডার অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ারঃ ১৯০৩ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘কম্পায়েন্ট অফ দ্য অর্ডার অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ ভূষিত হয়েছিল।
- নাইট উপাধিঃ বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিল।
- রয়্যাল সোসাইটির ফেলোঃ তিনি ১৯২০ সালের ১৩ই মে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন ।
- ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্সঃ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯২৮ সালে তিনি ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য হন।
- স্যার উপাধিঃ বৃটিশ সরকার বিজ্ঞানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্বদেশে বিজ্ঞান চর্চার প্রসারের জন্য কলকাতার রাজাবাজারে ১৯১৭ সালের ৩০ শে নভেম্বর “বোস ইনস্টিটিউট” বা “বসু বিজ্ঞান মন্দির” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর জীবনের শেষ অবধি পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।
জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) তার নিজস্ব অর্থ ও সংগৃহীত ১১ লক্ষ টাকা অনুদানের অর্থে প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি হল— প্রথমত, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও জ্ঞানের প্রসার সাধনই ছিল এটি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার সময় বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে যে সমস্ত সরকারী বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি একটি স্বাধীন বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন।
আজকের দিনে এই বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট বিজ্ঞান চর্চার জন্য একটি বিখ্যাত কেন্দ্র হিসাবে পরিগনিত ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর শেষজীবন
১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পরেও তিনি গবেষণা কাজ চালিয়ে যান এবং ধীরে ধীরে তাঁর পরীক্ষাগারটি নিজের বাড়িতে স্থানান্তরিত করেন। মহান বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, যিনি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, তিনি ১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর ৭৯ বছর বয়সে ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জগদীশ চন্দ্র বসুর উক্তি
বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর কিছু সেরা বাণী–
১) “সত্যিকারের পরীক্ষাগার হল মন, যেখানে মায়ার পিছনে আমরা সত্যের আইন উন্মোচন করি” ।
২) “জ্ঞান কখনোই কোনো একটি বর্গের একচেটিয়া অধিকার নয়, বরং পুরো বিশ্ব পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং চিন্তাভাবনার একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা বহু শতাব্দী ধরে মানবজাতির সাধারণ ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে”
উপসংহার
জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী (Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali) থেকে জানতে পারি যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকলে কম ব্যবস্তা ও সরঞ্জামের মধ্যে মহান আবিষ্কার করা যায়। আজ জগদীশ চন্দ্র বসু আমাদের মাঝে উপস্থিত নন, তবে বিজ্ঞানে তার দ্বারা তৈরি দুর্দান্ত আবিষ্কারের জন্য প্রায়ই তাকে স্মরণ করা হবে। তার (Jagadish Chandra Bose)আবিষ্কারগুলি কেবল আধুনিক বিজ্ঞানীদের অনুপ্রাণিত করে না, আগত প্রজন্মের মনে বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ তৈরি করেছে।
Frequently Asked Questions
Q1: জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম কবে ও কোথায় হয়েছিল ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম হয়েছিল ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ সালে অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুর জেলার রাঢ়িখাল গ্রামে ।
Q2: জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা মাতার নাম কী ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু ও মাতার নাম বামাসুন্দরী দেবী ।
Q3: জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা পেশায় কি ছিলেন ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু পেশায় ছিলেন প্রথমে প্রধান শিক্ষক ও পরে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ।
Q4: জগদীশ চন্দ্র বসুর উল্লেখযোগ্য পুরস্কার কী কী ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসুর উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার হল সিআইই (১৯০৩), সিএসএই (১৯১১), নাইট ব্যাচেলর (১৯১৭)।
Q5: জগদীশ চন্দ্র বসু কী জন্য স্যার উপাধি পান ?
Ans: তৎকালীন বৃটিশ সরকার বিজ্ঞানের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ জগদীশ চন্দ্র বসুকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করে ।
Q6: জগদীশ চন্দ্র বসু কবে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯২০ সালে ১৩ মে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হন ।
Q7: ‘গাছের প্রাণ আছে’ কে প্রথম বলেন ?
Ans: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম বলেন ‘গাছের প্রাণ আছে’ ।
Q8: জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কার কী ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিস্কারগুলি হল মিলিমিটার তরঙ্গ, বেতার, ক্রেসকোগ্রাফ, উদ্ভিদবিজ্ঞান ।
Q9: জগদীশ চন্দ্র বসু কবে মারা যান ?
Ans: জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর মারা যান ।
Q10: আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কতো সালে ডক্টরেট উপাধি পান ?
Ans: আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি পান ।
এই লেখাটি পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ । আশাকরি ভালো লেগেছে । ভালো লাগলে শেয়ার করে বন্ধুদের পাঠিয়ে দেবেন । তারাও আপনার মাধ্যমে লেখাটি পড়তে পারবে ও অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবে । এই ধরনের আরও লেখা পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি সাবক্রাইব করে রাখবেন । লেখার মান কেমন হল কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না । কোনও পরামর্শ বা তথ্য দেওয়ার থাকলে তাও কমেন্টে জানাবেন । ধন্যবাদ ।
Nice 👌👌👌👩👩👩
Nice.