ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী Ishwar Chandra Vidyasagar Biography
জীবনে আজ যতটুকু শিক্ষা হইলো সারা,
আমি নিরুত্তর হয়ে ভাবি, তুমি না থাকিলে সেটুকুও হত কিনা সারা …!!
ঠিক ধরেছেন । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) বা দয়ার সাগর ।তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাণপুরুষ তথা বাংলা ভাষার জনক ও বাঙালি জীবনের স্মারক সিংহশিশু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যিনি দেখিয়েছেন কর্ম-নিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাসকে পাথেয় করে কিভাবে ব্যক্তিত্বশীল পুরুষ হয়ে ওঠা যায়। তিনিই শিখিয়েছেন সমাজকে রক্ষা করতে ও বাঙালি জাতিকে স্বমহিমায় বিরাজ করতে।
মহান মহান জ্ঞানী মানুষরা সমাজের উপর প্রভাব রেখে গেছেন। এই রকমই এক ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar)। যিনি খুব বিনয়ী ছিলেন এবং নিজের জীবন দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষে কাটিয়ে ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(Ishwar Chandra Vidyasagar) মহান সমাজ সংস্কারক, লেখক, শিক্ষক ও উদ্যোক্তা ছিলেন এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করে গেছেন অবিরাম। ভারতে শিক্ষার প্রতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের(Ishwar Chandra Vidyasagar) অবদান এবং নারীর অবস্থার পরিবর্তন জন্য তিনি চির স্বরণীয়।
১৮৩৯ সালে ল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন । সাগর উপাধি তার জন্য যথার্থই ছিলো । বিদ্যার সাগর, জ্ঞানের সাগর, দয়ার সাগর, করুণার সাগর, মানবতার সাগর, প্রগতিশীলতার সাগর, বিবেকের সাগর সব বিশেষণই তার ক্ষেত্রে যথাযথ ও সুপ্রযোজ্য । যদি বলা হতো ব্যক্তিত্বের সাগর, বোধ করি তাও অপ্রযুক্ত হতো না ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) কে ছিলেন ?
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার । ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামেও স্বাক্ষর করতেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল তার। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর(Ishwar Chandra Vidyasagar)।
তাঁর আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কিন্তু তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন, যার অর্থ ‘জ্ঞানের সাগর’।
সংক্ষেপে বলা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি নম্র সূচনা হয়েছিল, কিন্তু তিনি একজন উচ্চ সম্মানিত শিক্ষাবিদ, লেখক এবং সমাজ সংস্কারক হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষাও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অমূল্য এবং তিনি এখনও ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত ব্যক্তি হিসাবে স্মরণীয়।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনীছক
নাম (Name) | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা (Ishwar Chandra Vidyasagar or Ishwar Chandra Bandyopadhyay or Ishwar Chandra Sharma) |
জন্ম (Birthday) | ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০(26 September 1820) |
জন্মস্থান (Birthplace) | বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা, ব্রিটিশ ভারত(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়) |
অভিভাবক (Parents)/ পিতা ও মাতা | বাবাঃ ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাঃ ভগবতী দেবী |
পেশা (Occupation) | লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রকাশক, সংস্কারক, মানবহিতৈষী |
ছদ্মনাম | কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য |
দাম্পত্যসঙ্গী (Spouse) | দিনময়ী দেবী |
সন্তান | নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় |
সাহিত্য আন্দোলন | বাংলার নজাগরণ |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | সংস্কৃত কলেজ(১৮২৮-১৮৩৯) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলী | বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা |
মৃত্যু (Death) | ২৯ জুলাই ১৮৯১(29th July 1891) |
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের( Ishwar Chandra Vidyasagar) জন্ম
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ‘দয়ার সাগর’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ২৬শে সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেন্সির বীরসিংহ গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । বীরসিংহ গ্রামটি তৎকালীন সময়ে হুগলী জেলার অন্তর্গত ছিল, কিন্তু অধুনা ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর । পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতামাতা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা ভগবতী দেবী। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা নিজেদের শিক্ষা, সংস্কার, আন্তরিকতা, কঠোরতা, দয়ালুতা ও নিষ্ঠার জন্য প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, যার কারণে তিনি অমর।
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পেশায় কলকাতায় স্বল্প বেতনের চাকুরীজিবী ও মাতা ভগবতী দেবী ছিলেন গৃহপত্নী।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শৈশবকাল
ইশ্বরচন্দ্রের পিতা কর্মসূত্রে বেশিরভাগ সময়ই কলকাতায় কাটাতেন । সেই কারণেই বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শৈশব জীবন তার মা ও ঠাকুরমা শ্রীমতী দূর্গাদেবীর সঙ্গেই অতিবাহিত হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) গ্রাম্য পাঠশালাতেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করেন এবং বাল্যকাল গ্রামের বাড়িতেই কাটান । পরে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবন
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রাথমিক শিক্ষা
পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাল্যশিশু ঈশ্বরচন্দ্রকে মাত্র চার বছর নয় মাস বয়সে গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি করে দেন। তার পরবর্তীতে ঈশ্বরচন্দ্রের( Ishwar Chandra Vidyasagar) পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের উদ্যোগে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামে এক উৎসাহী জ্ঞানী যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন পাঠশালা স্থাপন করলে আট বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র ঐ পাঠশালায় ভর্তি হন। আদর্শ শিক্ষক কালীকান্তের পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেন।
তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র পুরোহিত, এবং পরিবারটি আর্থিকভাবে সংগ্রাম করত, যার কারণে ঈশ্বরচন্দ্রের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে শিক্ষকদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হতেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উচ্চ শিক্ষা
১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। কথিত আছে, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষাগুরু কালীকান্ত মহাশয় ও চাকর আনন্দরামের সহিত পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প সময়েই অল্প বয়সে আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন।
কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে থাকাকালীন সময়ে মাত্র নয় বছর বয়সে ১৮২৯ সালের জুন মাসে কলকাতা গভর্মেন্ট সংস্কৃত কলেজে(যা বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি একই শ্রেণীতে সাড়ে তিন বছর অধ্যায়ন করেন। এই কলেজে ঈশ্বরচন্দ্রের( Ishwar Chandra Vidyasagar) সহপাঠী ছিলেন বিখ্যাত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
ঈশ্বরচন্দ্র ব্যাকরণ পাঠের পাশাপাশি ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পান। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান।
১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ থেকে ইংরাজি শিক্ষা উঠিয়ে দেওয়া হলে এখানেই ইংরাজি শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বর্ষের সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হয়ে পনেরো বছর বয়সে অলংকার শ্রেণীতে প্রবেশ করেন। অলংকার শাস্ত্র একটি কঠিন বিষয় হওয়ার সত্ত্বেও মাত্র এক বছরের মধ্যে সাহিত্য দর্পন, কাব্যপ্রকাশ ও রস গঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকার গ্রন্থে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে।
১৮৩৬ সালে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার অর্জনের মাধ্যমে অলংকার পাঠ শেষ করেন। ১৮৩৭ সালের মে মাসে ঈশ্বরচন্দ্রের ( Ishwar Chandra Vidyasagar)মাসিক বৃত্তি বেড়ে হয় আট টাকা।সে বছরই অর্থাৎ ১৮৩৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র স্মৃতি শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তারপরও পিতার অনুরোধে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। ১৮৩৮ সালে বেদান্ত পাঠে প্রথম স্থান অধিকার অর্জনের মাধ্যমে তা সমাপ্ত করেন। সংস্কৃতে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৪০-৪১ সালে ন্যায় শ্রেণিতে পঠনপাঠন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা-সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন।
তিনি বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত এবং অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান সংগ্রহ করেন । তাঁর বিদ্যার ভুগোল আমাদের সকলের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য কাজ করেছিল । তিনি নিজেকে একজন অভিজ্ঞ ছাত্র হিসেবে স্বীকৃত করেছিলেন এবং তাঁর ছাত্রদের প্রশ্নের সমস্যার সমাধান করার জন্য সকল উপায় নেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) ছাত্র জীবনে তাঁর দুটি প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রতিযোগিতা মূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করা । তার পিতা তখন ৮ টাকা বেতন পেতেন । এই আট টাকা বেতন থেকে তার জন্য ব্যয় হতো ৪ টাকা । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১২ বছর কাব্য, ব্যাকরণ, অলঙ্কার শাস্ত্র, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায়, জ্যোতিষ প্রভৃতি পাঠ করে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিবাহ
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পঠনরত সময়ে ( Ishwar Chandra Vidyasagar)ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সহিত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন । তাদের সন্তানের নাম নারায়ন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন
১) ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সম্পন্ন করার পর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ৫০ টাকা বেতনে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৪৬ সালের ৫ই এপ্রিল এই পদে দায়িত্ব সামলানোর পর ৬ই এপ্রিল থেকে একই বেতনে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করে।
২) ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে কলেজ পরিচালনার কাজে সেক্রেটারি রসময় দত্তের সাথে মতান্তর ঘটলে সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। এরপর ১৮৪৯ সালের মার্চ মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে চাকুরী গ্রহণ করেন।
৩) ১৮৫০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের চাকুরী পরিত্যাগ করে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসে ঐ কলেজেরই অধ্যক্ষ হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৮৫৮ সালের নভেম্বরে অধিকর্তার সাথে মতবিরোধের জেরে অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন।
৪) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) পরে বঙ্গদর্শন নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন এবং তাঁর প্রচারিত লেখা হল সাধারণ মানুষের জীবনে একটি পরিপূর্ণ ধর্মমূল্য। তাঁর লেখাগুলি মানব সমাজের সমস্যাগুলি উত্থান করার জন্য প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ছিল।
৫) তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্ট কলেজের সাহিত্য বিভাগে সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের জন্য সাহিত্য পড়াশোনার কৌশল শিখান। তিনি একজন উচ্চশিক্ষার্থীদের জন্য পুস্তক লেখা এবং সম্পাদনা করা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবেও কাজ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পণ্ডিত উপাধি
১৮৪১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান পন্ডিতের পদ লাভ করেন । তখন থেকেই তাঁর নামের সামনে পণ্ডিত শিরোপা যুক্ত হয় । তাকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় ।
সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) সমাজ সংস্কারে একটি গভীর স্বচ্ছন্দ মনোভাব ও অনন্য সাধারণ ভূমিকা বাঙালী জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে । যুগে যুগে সমাজে যখনই দেখা দিয়েছে সামাজিক সংকট তখনই দেখা দিয়েছে ভগবানের এক রূপ।

বিদ্যাসাগর তৎকালীন হিন্দু সমাজের প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা, কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অবদান রেখেছেন। যেমনঃ
নারী শিক্ষার প্রসার
ঈশ্বরচন্দ্রের( Ishwar Chandra Vidyasagar) হাত ধরে এসেছে তৎকালীন পুরুষ শাসিত সমাজের নারীর অত্যাচার থেকে মুক্তি। মাতা ভগবতী দেবীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার উদ্দেশ্য স্বরূপ নারীমুক্তি আন্দোলনকে পাথেয় করে তোলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, নারীশিক্ষার প্রগতি না করতে পারলে নারী সমাজের অগ্রগতি কখনই সম্ভব না। তার জন্য প্রয়োজন সমাজের নারীদের শিক্ষিত করে তোলা ।
সেইকারণে নারী শিক্ষা প্রসারে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। মিঃ বেথুনের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি হিন্দু ফিমেল স্কুল(১৮৪৯খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। প্রায় এক হাজার তিনশো ছাত্রী এই বিদ্যালয়গুলিতে পড়াশুনা করত।
বিদ্যালয় স্থাপন
বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে সবার আগে জোর দিয়েছিলেন বিদ্যালয় স্থাপনের ওপর । কারন, বিদ্যালয় না হলে শিক্ষার ভীত স্থাপন করা যায় না ।
অবৈতনিক, মডেল ও মেট্রোপলিটন স্কুল স্থাপন
১৮৫৩ সালে তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে চালু করেন প্রথম অবৈতনিক বিদ্যালয়। তিনি নিজে বিভিন্ন জেলায় ২০টি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার বেশিরভাগই তার নিজের খরচে চলত। এছাড়া ১৮৭২খ্রিঃ তিনি নিজে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত।
নর্ম্যাল স্কুল ও বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন
বাংলা তথা মাতৃভাষা শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তারই( Ishwar Chandra Vidyasagar) তত্ত্বাবধানে ১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে সংস্কৃত কলেজের অধীনে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়াও হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনা মতো দক্ষিনবঙ্গের চার জেলা অর্থাৎ নদীয়া জেলায় ৫টি, হুগলী জেলায় ৫টি, বর্ধমান জেলায় ৫টি ও মেদিনীপুর জেলায় ৪টি সহ মোট ১০১টি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন।
বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন
তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ১৮৫৭ সালের নভেম্বর- ডিসেম্বর মাসে হুগলী জেলায় ৭টি ও বর্ধমান জেলায় ১টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন ।১৯৫৮ সালে হুগলী জেলায় আরো ১৩টি, বর্ধমান জেলায় ১০টি, মেদিনীপুরে ৩টি ও নদীয়া জেলায় ১টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয়।
বিধবা বিবাহ প্রচলন
বিধবা বিবাহ রোধ এর জন্য তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) আন্দোলনে নামেন। ১৮৫৫ সালে বিধবা বিবাহ প্রচলিত কিনা সে সম্পর্কে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। শাস্ত্রীক নিয়মের দোহাই দেওয়া সমাজপতিদের তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে বিধবা নারীরাও মানুষ, তাদেরও সমাজে বাঁচার অধিকার আছে। বিধবা বিবাহ আইন পাস করার জন্য ১০০০ ব্যক্তির স্বাক্ষর নিয়ে একটি আবেদনপত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠান।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর সহায়তায় রাজা রামমোহন রায় যে ‘সতীদাহ প্রথা’ রদ করেছিলেন, তারই পন্থা হিসাবে বিদ্যাসাগর মহাশয়( Ishwar Chandra Vidyasagar) ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই লর্ড ডালহৌসির সহযোগিতায় ‘বিধবা বিবাহ’ আইন পাশ করিয়ে বিধবা নারীদের দেন সমাজে মুক্তির স্বাদ। হিন্দু বিধবা নারীদের কাছে তিনি এক মহামানব স্বরূপ । তিনি নিজ পুত্রকে দিয়ে প্রথম বিধবা বিবাহ করান । এমনকি তিনি নিজ খরচে বিধবাদের বিবাহও দিয়েছিলেন।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ
হিন্দুধর্মে মেয়েদের বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধি দূর করার জন্য তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) নিরলস সংগ্রাম করেন। তিন ‘সর্ব শুভকরী’ পত্রিকায় বাল্য বিবাহের দোষ’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশ করে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। এ ব্যাপারে তিনি সফলও হন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকার আইন করে মেয়েদের বিবাহের বয়স কমপক্ষে ১০ বছর ধার্য করে।
বহুবিবাহ প্রতিরোধ
সে যুগে পুরুষ শাসিত হিন্দুসমাজে পুরুষের বহু বিবাহ করার অধিকার ছিল। ফলে কুলিন সমাজে এই প্রথার বহুল প্রচলন ছিল। বিদ্যাসাগর( Ishwar Chandra Vidyasagar) এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হন এবং এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার’ নামক একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু বহুবিবাহ প্রসঙ্গে তিনি বিশেষ সাফল্য পাননি।
দুস্থ মহিলাদের সেবা–সহায়তা
দুস্থ মহিলাদের সেবা–সহায়তা দিয়ে বাঁচানোর জন্য। তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) ‘হিন্দু ফ্যামিলি এ্যানুয়িটি ফান্ড’ গঠন করেন স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের ব্যবস্থাও করেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহিত্য চর্চা
একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন প্রখ্যাত লেখক এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন । তিনি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং সামাজিক সমস্যা সহ বিস্তৃত বিষয়ের উপর অসংখ্য বই এবং নিবন্ধ লিখেছেন। তার কাজগুলি অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল এবং তার সময়ের সমাজে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল ।
১) ১৮৪৭ সালে গড়ে তোলেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজেটরি নামে একটি বইয়ের দোকান এবং বন্ধু মদন মোহনের সম-অংশীদারিত্বে গড়ে তোলেন সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা। এখানে তাঁর( Ishwar Chandra Vidyasagar) প্রথম গ্রন্থ ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ প্রকাশিত হয়।
২) তাঁর প্রথম রচনাগুলির মধ্যে অন্যতম ‘বৃহত্তর মহাভারত’, ‘শকুন্তলা’, ‘মেঘের ওপারে’, ‘বুদ্ধচরিত’, ইত্যাদি রয়েছে । ১৮৪৭ সালে বেতাল পঞ্চবিংশতী হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদ করার মাধ্যমে তার সাহিত্যচর্চায় খ্যাতি অর্জন করতে থাকে। এরপর তিনি সীতার বনবাস, মহাভারতের উপক্রমনীকা সংস্কৃত থেকে বাংলায় এবং বাঙলার ইতিহাস, জীবন চরিত, নীতিবোধ ইংরাজি থেকে বাংলায় রচনা করেন।
৩) শিক্ষামূলক গ্রন্থ হিসাবে ১৮৫৫ সালের ১৩ই এপ্রিল বাংলা ভাষার হাতেখড়ি জন্য শিশু পাঠ্য বর্ণমালা শিক্ষাগ্রন্থ বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৮৫১-১৮৫২তে ঋজুপাঠের ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড, ১৮৫৩ সালে ব্যাকরণ কৌমুদি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা রচনা করেন। বিদ্যাসাগর স্কুল বিভাগের শিক্ষার জন্য এছাড়াও অনেক গ্রন্থ, যেমন- বোধোদয়, কথামালা, চরিতাবলী প্রভৃতি রচনা করেন ।

৪) এছাড়াও তাঁর( Ishwar Chandra Vidyasagar) সম্পাদনায় কিছু গ্রন্থ অন্নদামঙ্গল, কুমারসম্ভবম, রঘুবংশম, মেঘদূতম, অভিজ্ঞান শকুন্তলম, সর্বদর্শ সংগ্রহ, কাদম্বরী, উত্তর রামচরিত প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
৫) পাশাপাশি তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেছিলেন, যেমন- সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, ব্রজবিলাস, প্রভাবতী সম্ভাষণ, রত্নপরীক্ষা, শব্দমঞ্জুরী ।
৬) সমাজসংস্কার মূলক- ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা, এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা, এতদ্বিশয়ক প্রস্তাব’ বিষয়ে রচনা করেন। তিনি অনেকগুলি প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং ছোটগল্প রচনা করেছেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বিশেষ কিছু কথা
১) তিনি( Ishwar Chandra Vidyasagar) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ।
২) মাতৃভক্তির জন্যও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবদন্তী হয়ে আছেন ।
৩) তিনি চিরদিন কুসংস্কার, গোঁড়ামি আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন ।
৪) বাঙালী জাতি সর্বপ্রথম বড় হবার, যোগ্য হবার, মানবিক হবার, আধুনিক হবার, প্রগতিশীল হবার ও বিশ্বজনীন হবার সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিলো বিদ্যাসাগরের মধ্যে ।
৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্বন্ধে বলেছেন— ‘তিনি হিন্দু ছিলেন না, বাঙালী বা ব্রাহ্মণ ছিলেন না, ছিলেন মানুষ’ । এই মন্তব্যের তাৎপর্য অতলস্পশী । কারণ, কারো যথার্থ মানুষ হওয়া অতো সহজ নয় । রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন— ‘তাহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে’ ।
৫) ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন— ‘বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা গদ্যের চল ছিল, কিন্তু চাল ছিল না’ । বিদ্যাসাগর সর্ব প্রথম বাংলা গদ্য রচনায় নির্দিষ্ট রূপ ও আকার দিয়ে মানুষের মনের মধ্যে ছাপ ফেলেছেন ।
৬) তাকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয় । বাংলা বর্ণমালার রূপকার বলা হয় ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুরস্কার ও সম্মাননা
বাঙালি সমাজ তথা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে বিদ্যাসাগর মহাশয় আজও এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন উচ্চ সম্মানিত শিক্ষাবিদ, লেখক এবং সমাজ সংস্কারক । শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অমূল্য এবং তিনি এখনও ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত ব্যক্তি হিসাবে স্মরণীয়।
১) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম বাঙালি লেখক যিনি ভাষার সংরক্ষণ, সমাজ উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও সাহিত্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর লেখাগুলি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে একটি মূল স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ দেশের সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক সংস্কৃতি বিভাগের তারকা পুরস্কার হিসাবে প্রদান করা হয়। এই পুরস্কারটি তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতে প্রদান করা হয়।
২) তিনি একজন দৈনন্দিন মানবতা এবং সমস্যাগুলির মধ্যে থাকা সমস্যাগুলি উপেক্ষা না করে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে সমর্থ করে আসেন। তাঁর লেখাগুলি পরিবার ও সমাজের ভালবাসা ও সংস্কার নির্মাণে একটি উপযোগী নির্দেশিকা হিসাবে পরিগণিত হয়। তিনি ১৯৩১ সালে সদস্য হিসেবে সাহিত্য সভার সম্মানিত হয়েছেন। এর পর তিনি ১৯৫১ সালে ‘জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার’ জিতেন। এছাড়াও তিনি সাহিত্য প্রকাশক এবং অন্যান্য শিক্ষাতথ্য প্রকাশকদের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
৩) ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৯ সালের ২২শে এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার ফলস্বরূপ ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি পান। এছাড়াও, তিনি ছাত্রদের মধ্যে প্রচুর প্রচেষ্টা করেছেন যাতে তারা বিদ্যা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে সম্মিলিত হতে পারেন। তিনি একজন উত্তম শিক্ষক হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর শিক্ষানুভব আজও সামান্য অংশ রাখছে এবং এর মাধ্যমে তিনি আজও বিশ্ব জনগণের হৃদয়ে জীবিত রয়েছেন।
৪) তার স্মৃতি রক্ষার্থে এ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ‘বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়েছে, কলকাতায় আধুনিক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসাবে ‘বিদ্যাসাগর সেতু’ নামকরণ করা হয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনাবসান
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন— “আমি যে দরিদ্র বাঙালী বাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি, তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর” ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেষ জীবনে অত্যন্ত দুঃখজনক অবস্থায় ছিলেন। তিনি ১৮৯১ সালে কলকাতার একটি নাটকের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য নাটকের লেখার কাজ করছিলেন। সেই সময় তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন এবং নাটকের লেখার কাজ শেষ না হলেও এর জন্য সমস্যায় পড়েন। এরপর তিনি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আশ্রমে যান।
কিছুদিন পরে বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় লিভারে ক্যানসার আক্ৰান্ত হয়ে ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তার কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে কিছু লেখা এবং গবেষণা হল
- ‘স্ত্রী শিক্ষার সামাজিক প্রতিষ্ঠান’(1893)- একটি বই যেখানে তিনি স্ত্রীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং তাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কীভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
- ‘বিদ্যালঙ্কার’(1894)- একটি পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত একটি লেখা যেখানে তিনি শিক্ষার সাথে মনোবোধ সম্পর্কে বিবেচনা করেন।
- ‘সমাজ সংস্কারের উপদেশমালা’(1895)- একটি গ্রন্থ যেখানে তিনি সমাজের উন্নয়ন ও সংস্কার পর্যালোচনা করেন।
- ‘ভুল করা নয়’ শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ’(1910)- একটি লেখা যেখানে তিনি বিদ্যার গুরুত্ব ও শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন পর্যালোচনা করেন।
- ‘শিক্ষা ও সংস্কার’(1915)- একটি গ্রন্থ যেখানে তিনি শিক্ষার সাথে মনোবোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
- ‘আধুনিক বাঙালির চেতনা’(1915)- একটি লেখা যেখানে তিনি বাঙালি সমাজের বর্তমান অবস্থা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা করেন।
- ‘বাংলা সমাজে নারী’(1915)- একটি গ্রন্থ যেখানে তিনি বাংলা সমাজে নারীদের অবস্থা এবং সমাজ সংস্কারে তাঁদের ভূমিকা পর্যালোচনা করেন।
- ‘প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা’(1917)- একটি গ্রন্থ যেখানে তিনি শিক্ষার প্রাচীন এবং আধুনিক রূপের উন্নয়ন পর্যালোচনা করেন।
Frequently Asked Questions
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম কবে হয় ?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ২৬ সেপ্টম্বর ১৮২০ সালে ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ও মাতার নাম কী ?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পিতা ছিলেন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ছিলেন ভগবতী দেবী ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম কী ?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বর্ণপরিচয়, কথামালা , চরিতাবলী , ঋজুপাঠ প্রভৃতি ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘পণ্ডিত’ উপাধি কত সালে পান ?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পণ্ডিত উপাধি পান ১৮৪১ সালে
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর নাম কী?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রী ছিলেন দিনময়ী দেবী ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
ANS: পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোন নামে সাক্ষর করতেন?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা দুই নামেই স্বাক্ষর করতেন।
সংস্কৃত কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
ANS: সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮২৮ সালে ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুত্রের নাম কী?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুত্রের নাম নারায়ণ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কবে মারা যান?
ANS: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় ২৯ জুলাই ১৮৯১ সালে ।
এই লেখাটি পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ । আশাকরি ভালো লেগেছে । ভালো লাগলে শেয়ার করে বন্ধুদের পাঠিয়ে দেবেন । তারাও আপনার মাধ্যমে লেখাটি পড়তে পারবে ও অনেক অজানা তথ্য জানতে পারবে । এই ধরনের আরও লেখা পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি সাবস্ক্রাইব করে রাখবেন । লেখার মান কেমন হল কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না । কোনও পরামর্শ বা তথ্য দেওয়ার থাকলে তাও কমেন্টে জানাবেন । ধন্যবাদ ।
Unbelievable biography of Vidyasagar